"রহস্যে ঘেরা "পর্ব-১০

রহস্যে ঘেরা

পর্ব: 10 (শেষ পর্ব)

সামিয়ার মুখে একই সাথে হাসি আর বিস্ময় ফুটে উঠলো। কারণ যেই জিনিসটা তার দিকে উড়ে আসছে সেটা আর কেউ নয়, আয়ান নিজে। সামিয়া তার উড়ার বেগ বাড়িয়ে দিলো।
কাছাকাছি আসতেই দুইজন দুইজনকে জড়িয়ে ধরলো। এইবার তাদের মধ্যে আগের সেই বন্ধন নেই। তাদের মধ্যে আপনজনের অনুভূতি অনুভূত হলো।
সামিয়া বুঝতে পারলো না আয়ান কি করে জীবিত আছে এখনো? আর সে এইভাবে ভ্যাম্পায়ার রুপে আকাশে উড়ছে কি করে?
কিন্তু এইসব কিছুর চেয়ে সামিয়ার কাছে যেটা সবচেয়ে জরুরী সেটা হলো আয়ান জীবিত আছে।


সামিয়া আর আয়ান দুইজন মাটিতে নেমে এলো। সামিয়া তার সাথে ঘটা সব কিছু তাকে খুলে বললো। এখন আয়ানের পালা সব খুলে বলার। সে বলতে শুরু করে দিলো।
-"ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে তখন চলছিল উৎসব। আমাকে খুন করার উৎসব। তারা আমাকে মেরে তাদের প্রতিশোধ পূরণ করতে চেয়েছিলো। কারণ আমি তাদের রাজার ছোট পুত্র চার্লি কে ধ্বংস করেছিলাম। যার কারণে তার ভাই এরিক আরো রেগে যায়। পুরো ভ্যাম্পায়ার দুনিয়ার মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ভ্যাম্পায়ার। তার সমানে কেউ টিকতে পারতো না। কিন্তু তারা আমায় চিনতে ভুল করেছে। যখনই এরিক তার নখ যুক্ত হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় তখনই শুরু হয়ে যায় ইতিহাসের দ্বিতীয় নৃশংস অধ্যায়। যেই শক্ত খুটির সাথে আমাকে বাধা হয়েছিলো নরে ওঠে সেটা। বিশাল আর কয়েক টন ওজনের খুটি তোলা এরিকের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। তাই সবাই বিস্মিত হয়ে যায়। এতকিছুর মধ্যেও আমার চেহারার কোন পরিবর্তন না দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে যায় এরিক। রেগে এগিয়ে আসতে থাকে আমার দিকে।
ঠিক তখনই মুখে একটা তীক্ষ্ণ হাসি নিয়ে লাফিয়ে উঠি আমি। সাথে পুরো খুটি উপ্রে যায়। যা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় সবাই। শূন্যে ভেসে দুই হাত দিয়ে উঠিয়ে নেই সেটা আর মাঝখান দিয়ে দ্বি-খন্ডিত ছুড়ে দেই সেটা এরিকের দিকে।
বিশাল সেই খুটির সামনে এরিকের নগন্য দেহ চাপা পড়ে যায়। পিষে যায় সে। ভ্যাম্পায়ার রাজ পুত্রের সেই অবস্থা আর আমার ক্ষমতা দেখে পালাতে শুরু করে দেয় সব ভ্যাম্পায়ার। রাজা তখনও শুধু পাথর হয়ে দেখেই যাচ্ছিলো সব। কিন্তু তার সেনারা চুপ থাকেনি। তারা উড়ে আসতে থাকে আমায় আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু তাদের ধারণা ছিলোনা আমি কে?
মুহূর্তের ভিতরে বিশাল থেকে বিশাল আকৃতির হয়ে যাই আমি। হাতের দুই আঙুল দিয়ে পিষে ফেলতে থাকি সবাইকে। আমার সামনে কেউ টিকতে না পেরে মাথা নত করে।
তখন আমি চলে যাই রাজার সামনে।
রাজা আন্দাজ করতে পেরেছিল আমি কে হতে পারি। তাই সে শুধু বিস্ময় ভরা নয়নে আমায় একবার জিজ্ঞেস করেছিলো আমি বেঁচে আছি কি করে ? তখন আমার জবাব ছিল, প্রকৃতির যখন ইচ্ছা হয় তখন সে তার ইচ্ছাতে বাঁচিয়ে নেয় আমাকে।"
এরপর আর তাকে কথা বলার কোন সুযোগ দেইনি আমি। সোজা চলে আসি আমার নাগ রূপে। আর লেজ দিয়ে পেচিয়ে ধরি তাকে। প্রতিবাদ করার কোন উপায় তার ছিলনা। কারণ সে জানে প্রতিবাদ করলে তার পরিণতি আরো ভয়াবহ হবে। তাই আমি সেই অবস্থাতেই নিজের আকার বড় করতে থাকি। আমি তাকে পিষেই দিতাম। কিন্তু হঠাৎ করে মনে হলো এতে তার শাস্তি কম হবে। তাই তাকে বন্দি করে রেখেছি এমন জায়গায় যেখানে তার প্রতিটা মুহূর্ত নরকের মতো লাগবে।
এরপর আমি চলে যাই প্রাসাদের ভিতরে। সেখান থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে এই জায়গার উদ্দেশ্যে আসতে থাকি। কিন্তু আমি এখানে আসার রাস্তা জানতাম না। তাই আশেপাশে উড়তে থাকি, আর তখনই তোমাকে নজরে পড়ে। আর চলে আসি তোমার কাছে।"
সব শুনে সামিয়া বললো,
-"তুমি কে? আর আমার সাথে এইসব কেনো হলো। আর সেই ছবি আর মুকুট দেখে আমার কি হয়েছিলো? আমি যে আবছায়া প্রতিবিম্ব দেখেছি সেটা কি ছিল?
সামিয়ার এইসব প্রশ্ন শুনে আয়ান একটা হাসি দিয়ে বললো,
-"এইসব হওয়ারই ছিল আমার প্রিয় বোন।"
বোন শব্দটা শুনে সামিয়ার বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। কি বলছে সে! চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠলো তার।
আয়ান সেটা বুঝতে পেরে সামিয়ার হাতে একটা ছবি তুলে দিলো। সামিয়া দেখলো সেটা একটা মহিলার ছবি। সেদিকে ইশারা করে আয়ান বললো,
-"এটা আমাদের মা। আর নাগ দুনিয়ায় যেই ছবি পেয়েছিলে সেটা হলো আমাদের বাবার।"
সামিয়া ছবিটা হাতে নিয়ে দেখলো সামিয়ার মুখের সাথে অনেকটাই মিল আছে। আর ছবি দুটোর চোখ যেনো হুবহু সামিয়ার চোখের মতো। ছবিটা যেনো সামিয়াকে ডাকছে।
আয়ানের ডাকে সে তার দিকে ফিরে তাকায়।
আয়ান তাকে বলে,
-"বাকি সব প্রশ্নের উত্তর নাগ রাজ্যে গিয়ে দিবো। এখন সেখানে নিয়ে চলো আমাকে।"
সামিয়া বাঁধ্য মেয়ের মতো যেদিক দিয়ে এসেছিল সেই দিকে আয়ানকে নিয়ে যেতে থাকে।
জলের গভীর থেকে গভীরে গিয়ে তারা পৌঁছে যায় নাগ রাজের সেই সিংহাসনের সামনে।
সেখানে গিয়ে অবাক হয়ে যায় সামিয়া। কারণ যাওয়ার আগে সে দেখে গিয়েছিলো সব নাগ প্রজারা সিংহাসনের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে। আর এখনো তারা সেই অবস্থাতেই রয়েছে।
আয়ান দৃশ্যটা দেখে মুচকি হেসে সামিয়াকে নিয়ে সেই সিংহাসনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সামিয়ার হাত থেকে সেই তলোয়ার নিয়ে আয়ান নিজের কাছে রেখে দিলো। আর সেই মুকুট তুলে সামিয়ার মাথায় পড়িয়ে দিলো সে। সিংহাসনের উপর থেকে সেই যুবকের ছবি তুলে প্রাসাদের দেয়ালে লাগিয়ে দিলো। আর তার পাশে সেই মহিলার ছবি।
এরপর আয়ান সবার সামনে এসে দাঁড়ালো, আর অনেকটা ঘোষণার মতো করে বললো,
"আমি মহা শক্তিশালী রাজা সিন্থিস এবং এবং রানী আলিনার পুত্র আয়ান। আর সিংহাসনে যে বসে আছে সে হলো আমার বোন সামিয়া। এবং সেই আপনাদের ভবিষ্যতের রানী। এখন থেকে সবাই তার কথা শুনেই চলবে। আর যে তার বিরুদ্ধে যাবে বা তার কথা মান্য করবেনা তার ফলাফল হবে ভয়ানক।"
সবাই বাধ্য প্রজার মত সব শুনে গেলো আর সব শেষে জয়ধ্বণি দিতে লাগলো তাদের নামে। সামিয়া কিছুই বুঝতে পারছিল না এইসবের।
কিন্তু যতক্ষণ আয়ান আছে তার কিছু হবেনা এইটুকু বিশ্বাস আছে তার।
আয়ান এইবার সামিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-"এইবার তাহলে সব সত্য জানানোর সময় এসেছে। তাহলে শোন মনোযোগ দিয়ে!
অনেক বছর আগের কথা। তখন এই নাগ রাজ্য আর ভ্যাম্পায়ার রাজ্য উভয় শাসন করতো আমাদের বাবা আর মা। তারা জন্মের পর থেকেই ছিল সবার থেকে আলাদা। তাদের শক্তি ছিল অসীম। কিন্তু তারা কি বা কি জন্য শেয়ার শক্তির অধিকার ছিল তা কারো জানা ছিলনা। আর জেনেও কাজ নেই। কারণ তাদের পূর্ব পুরুষ সবাই ছিল রাজ বংশের। রাজ বংশের লোকেরা ছাড়া কেউ জানতো না যে ভ্যাম্পায়ার আর নাগ রাজ্য আলাদা ছিল। যেমন, নাগ রাজ্যের কেউ জানতো না যে ভ্যাম্পায়ার রাজ্য আছে? আবার ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের সাধারণ কেউ জানতো না যে নাগ রাজ্য আছে। এই দুই রাজ্যকে আলাদা আলাদা করে শাসন করতো একটা তৃতীয় পক্ষ। যারা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। আর সেই বংশের মধ্যে আবার সবার থেকে আলাদা আর শক্তিশালী হয়ে জন্ম গ্রহণ করে আমাদের বাবা মা। আমাদের বাবা মা ছিল সম্পর্কে দূরের ভাই বোন। কিন্তু পরিবার থেকে তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।
সব ভালোই চলছিল। কিন্তু মা বায়না ধরে তিনি পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করবে। তাই বাধ্য হয়ে বাবাও মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পৃথিবী ভ্রমণে। তখনই জন্ম হয় আমার আর তোমার। জমজ ছিলাম আমরা। সেই সময় আমরা বাংলাদেশের একটা হাসপাতালে ছিলাম। আর সেখানে আমাদের দুইজনের পালিত মা বাবাও তাদের সন্তান হওয়ার কারণে এসেছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ করে আক্রমণ হয় আমাদের মা বাবার উপর। তখনই বাবা বুঝতে পারে এইসব তাদের ষড়যন্ত্র যাদের বাবা দুটো রাজ্য সামলানোর দায়িত্ব দিয়ে এসেছে।
আমাদের মুখ চেয়ে বাবা কারো সাথে লড়াই না করে আমাদের দুইজন কে তার আর মায়ের সব শক্তি একত্র করে দিয়ে সাধারণ মানুষের মত হয়ে যায়।
আর তখন সেই বিশ্বাস ঘাতকের দল এসে খুন করে দেয় তাদের।
বাবা মারা যাওয়ার আগে তার শেষ ক্ষমতাবলে আমার চেহারা আমার পালিত বাবার সদ্য হওয়া পুত্রের মত করে দেয় আর আমার মাথায় সব স্মৃতি আর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে বাবা কিছুই করতে পারেনি। শুধু তোমাকে আর তোমার পালিত বাবার সন্তান কে পাল্টায়ে দিতে পারে।
আর শত্রুরা তাদের সন্তান কে আমরা ভেবে খুন করে দেয়। কিন্তু তারা জানতে পেরে যায় তুমি জীবিত আছো। কিন্ত তারা জানতো না আমিও জীবিত আছি।তাই তারা তোমার পিছু লেগে পড়ে।
আর আমি নিজেকে তৈরি করতে থাকি তাদের বিরুদ্ধে। নিজের সব শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে শুরু করি আর তারপর তোমাকে খুঁজে বের করে সাহায্য করি আর তোমাকেও নিজ শক্তিকে ব্যবহার করার ট্রেনিং দিতে শুরু করি। কিন্তু আমার সমস্যা ছিল আমি নাগ রাজ্য আর ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের অবস্থান জানতাম না। কিন্তু আমাদের তারা নিজেদের রাজ্যে নিয়ে গিয়ে সেটা সহজ করে দেয়। দুই ভাই বোন আমরা দুটো রাজ্যের বিশ্বাস ঘাতকদের শেষ করে দেই।"
-" কিন্তু ভ্যাম্পায়ার রাজ আর নাগ রাজের মধ্যে কি সম্পর্ক ছিল? "আয়ানের কথা শেষ হতেই প্রশ্ন করে বসে সামিয়া।
আয়ান একটু হেসে বললো,
-"তাদের ভিতর সম্পর্ক বলতে শুধু শত্রুতা ছিল। কারণ আমার বাবা মার বংশের তারা কেউ ছিলনা। তারা নিজ রাজ্যের আমাদের হয়ে কাজ করা সেনাপতি ছিল। যখন আমাদের বাবা মার শত্রুরা তাদের মেরে রাজ্য শাসন করতে শুরু করে তখন সেই সব সেনাপতি তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আর তাদের মেরে ফেলে। এইভাবে আমাদের বংশ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু শুধু বেঁচে যাই আমরা, আর আমাদের শক্তিসীমা এত যে কেউ আমাদের মারতে পারবে না।"
সামিয়া আবার প্রশ্ন করে,
-"তাহলে ওই তলোয়ার আমার হাতে চলে আসলো কেনো, আর ওই নাগ রাজ কেনো বলেছিলো সেটা দিয়ে আমার মৃত্যু সম্ভব?"

-"ওই তলোয়ার ছিল আমাদের বাবার। বাবার তলোয়ার ছিল অনেক ক্ষমতার। কিন্তু সেই তলোয়ার তার মালিকের রক্তের কাউকে ক্ষতি করতে পারেনা। তলোয়ার রক্ত চেনে। তাই তোমার কোন ক্ষতি সে করতে পারেনি। কিন্তু ওই মূর্খ নাগ রাজ ভেবেছিল সেটা দিয়ে তোমাকে মারতে পারবে।"
-"তাহলে এতদিন তুমি আমার সাথে যা করে এসেছ সেইসব কি ছিল?"
-" সব আমার নাটক ছিল। কারণ আমাদের প্রতিশোধ নেওয়ার ছিল। আর যদি তারা আমার পরিচয় জেনে যেতো তাহলে পৃথিবীর মানুষ বিপদে পড়তো। আর তার জন্যই এত কিছু।"
-"কিন্তু এখন আমাদের দায়িত্ব কি?"
-" এখন আমাদের দায়িত্ব হলো এই দুই রাজ্য দেখাশোনা করা। আর সেই জন্য এখন থেকে তুমি নাগ রাজ্য দেখবে আর আমি ভ্যাম্পায়ার রাজ্য।"
সামিয়া অশ্রূভেজা নয়নে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে।
আয়ান বুঝতে পারলো সামিয়া কি বলতে চায়। তাই সে নিজে থেকেই বললো,
-"এটাই হয়তো প্রতিকৃতি ইচ্ছা। সেই জন্যই আমরা ভাই বোন। তা ছাড়া আর কিছুই নেই আমাদের ভিতর।"
সেই অবস্থাতেই সামিয়া ঠোঁটে একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো। কারণ তাদের সমানে যে অনেক কাজ বাকি।

(সমাপ্ত)
Picked up.
 গল্পটা সম্বন্ধে আপনাদের ভালো খারাপ সব মতামত জানতে চাই। আশা করি যারা পুরো গল্পটা পড়েছেন তাদের ভিতর সমস্ত পাঠক পাঠিকা তাদের মন্তব্য জানিয়ে যাবেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত আলগী নদী!

সাথী হারা

"রহস্যে ঘেরা"পর্ব-০৪