"রহস্যে ঘেরা"
"রহস্যে ঘেরা"
অন্ধকার রাত! ঘোমটা দিয়ে বিছানার এক পাশে বসে আছে সামিয়া। আর আরেক পাশে উল্টো হয়ে শুয়ে আছে তার সদ্য বিয়ে করা স্বামী। বিয়ের রাতে বেশিরভাগ সময় ছেলেরাই মেয়ের ঘোমটা উঠায়। কিন্তু এইবার ঘটলো তার ব্যতিক্রম। সামিয়া ধীরে ধীরে তার স্বামীর কাছে এগিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে তার পাঞ্জাবির কলার ধরে সোজা করালো।
সাথে সাথে দূরে কোথাও একটা বাজ পড়লো। চারিদিক কয়েক মুহূর্তের জন্য আলোকিত হয়ে গেলো। সেই আলোয় সামিয়া দেখলো তার স্বামীর নিথর দেহের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। শরীর তার হিম শীতল।
এইটুকু দেখা আর বোঝার সাথে সাথে আবার চারিদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেলো। সামিয়া বুঝলো তার স্বামী আর এই দুনিয়ায় নেই। হঠাৎ করে জানালার ধারে খট করে কিসের যেনো একটা আওয়াজ শোনা গেলো।
সামিয়া সেদিকে তাকাতেই আবার বিদ্যুতের ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে গেলো এই চাঁদ বিহীন রাত।
সামিয়া সেখানে জানালার ধারে এক ভয়ানক মানব রুপি শয়তান দেখতে পেলো।
সামিয়া যখনই সেদিকে তাকালো তখনই কিছুর ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ শোনা গেলো। আর সাথে সাথে জানালার পাশ থেকে গায়েব হয়ে গেলো সেই ভয়ানক চেহারার মালিক।
সামিয়া আবার তার স্বামীর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলো। সে জানে পরবর্তীতে কি হবে। গত পাঁচ বারের মত এবারও সে বিয়ের রাতেই বিধবা হয়ে গেলো।
আর সকালে পুলিশ আসবে লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মৃত্যু রহস্য রহস্যই থেকে যাবে।
সামিয়ার ধারণা সত্যি করে দিয়ে সকাল থেকে সব ঠিক ঠিক সেগুলোই হলো। সামিয়ার কাছে এটা কোনও নতুন ঘটনা নয়।
সামিয়া তার বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। পরিবারের যেমন অর্থ আছে, তেমনি সামিয়ার রূপের এক ঝলক দেখলে ঘায়েল হয়ে যায় হাজারো যুবকের বুক। কিন্তু সেই রূপের গুণের সাথে রয়েছে একটা অভিশাপ। আর সেটা হলো বিয়ের রাত্রিতে মারা যায় সামিয়ার স্বামী।
মানুষ সামিয়াকে নানা ভাবে অপবাদ দিতে থাকে। কিন্তু প্রভাবশালী পিতা আর পরীর মতো চেহারার গুনে আবার কেউ না কেউ বিয়ে করতে চায় সামিয়াকে। কিন্তু তারও শেষ পরিণতি হয় মৃত্যু। মৃত্যুর কারণটা অদ্ভুত। রক্ত শুন্য দেহ, আর ঠিক গলার কাছে সূক্ষ্ম দুটো ছিদ্র। এছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না।
আর আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, সামিয়ার বিয়ে হয় ঠিক আমবস্যার রাতে। বাসর ঘরে ঢুকলেই অজ্ঞান হয়ে যায় সামিয়া। আর জ্ঞান ফিরলেই আবিষ্কার করে সামনে তার সদ্য বিয়ে করা স্বামীর মৃত দেহ।
এইবারও শশুর বাড়ির লোকেরা সামিয়া কে নানা ভাবে গালিগালাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। আর সামিয়া সবার মধ্যমনি। লাল বেনারশি শাড়ীতে তাকে পরীর মত লাগছিল।
কিন্তু সামিয়া সেখানে শুধু নীরব দর্শক ছিল। সামিয়ার বাবা একটু পর এসেই তাকে সেই ঝামেলা থেকে উদ্ধার করে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায়। তার বাবা মার মনটাও প্রচন্ড খারাপ।
এইবার আর সহ্য করতে না পেরে সামিয়ার মা সামিয়ার গালে কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।
মুহূর্তের ভিতরেই সামিয়ার কোমল গালে চার আঙুলের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাথে সাথে সামিয়ার চোখ কালো হয়ে উঠতে থাকে। গাঢ় কালো চোখ। দৃশ্যটা দেখে ভয় পেয়ে যায় সামিয়ার মা। কারণ সেই চোখের দৃষ্টি হিম শীতল। সেই দিকে তাকালে গায়ের প্রত্যেকটা লোম দাঁড়িয়ে যায়।
সামিয়া আর সেখানে থাকে না। সিঁড়ি বেয়ে চলে যায় উপরে। তার তেমন চিন্তা নেই, কারণ সে জানে তার বাবা ম্যানেজ করে নিবে সব কিছু। আর এতে তার কোনও দোষও নেই। সামিয়ার বিয়ে করার কোনও ইচ্ছা ছিল না। সে পড়ালেখা করতে চায়। কিন্তু তার বাবা জোর করে এক প্রভাবশালীর ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক করে ফেলে আর দিয়েও দেয়। কিন্তু বাসর রাতেই মারা যায় তার স্বামী।
এতে করে সামিয়ার বাবার আরো জেদ চেপে বসে। মেয়ে বাড়িতে থাকলে তাকে নানান কথা শুনতে হবে। তাই আবার বিয়ে দিয়ে দেয় তার মেয়েকে। কিন্তু ফলাফল একই। এইভাবে চলতে চলতে আজ পঞ্চম বারের মতো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো।
সামিয়া সোজা তার ঘরে চলে গিয়ে এক টানে গা থেকে শাড়ি খুলে ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। সেখানে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সে।
কি এমন নেই তার ভিতর যে তার ভিতর স্বামীর সুখ পাওয়ার আশাটুকু নেই। সামিয়া নিজের চোখের দিকে তাকায়। দেখে সেটা এখনো কালো হয়ে আছে। আর সেই গভীর কালো গহব্বর দিয়ে টপটপ করে পানি ঝড়ছে।
সামিয়া জানে সে ছোট থেকেই এইরকম। দিনের বেলা যখন সে রেগে যায় বা কষ্ট পায় তখন তার চোখ কালো হয়ে ওঠে। তখন
তার গা শীতল হয়ে যায়। আর তার পানির প্রতি একটা আকর্ষণ জাগে। তখন সে গোসল করে।
আর রাতের বেলা রেগে গেলে বা কষ্ট পেলে তার আগে মাত্রাতিরিক্ত লাল হয়ে ওঠে। আর সেই সময় সামিয়ার পিপাসা পায় প্রচুর। কিন্তু পানি খেলে সেই পিপাসা মিটে না তার।
সেই সময় সে ঘুমিয়ে পড়ে, আর ঘুম থেকে ওঠার পর সে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
এই ভাবেই কাটছিল সামিয়ার অদ্ভূত জীবন, যতদিন না পর্যন্ত তার বিয়ে ঠিক হয়।
এখন দিনের সময়। তাই সামিয়ার চোখ কালো হয়ে আছে। শরীরে ঠান্ডা পানির তীব্র অনুভূতি হচ্ছে তার। ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে তার নিচে দাঁড়ালো সে। তার শরীরের প্রতিটা কোষ শীতল পানির ফোটায় ভিজতে শুরু করে দিলো।
ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হয়ে যায়। তার চোখ স্বাভাবিক হয়ে যায়।
সামিয়া শরীরে একটা তাওয়াল পেচিয়ে বেরিয়ে আসে। শরীর তার ক্লান্ত। সারারাত জেগে ছিল, আবার সকালে এত কথা শোনার পর তার আর কিছুই ভালো লাগছে না। তাই সে ওই অবস্থাতেই বিছানাতে গা এলিয়ে দিলো, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো।
তার ঠিক কিছুক্ষণ পর সামিয়ার জানালার ধারে একটা সরু চিকন ছায়া নজরে এলো। দুই তোলা বাংলো বাড়ির আশেপাশে তেমন গাছ বা কোনো কিছু নেই যে সেটা বেয়ে কেউ সামিয়ার জানালায় উঠতে পারবে।
কিন্তু সেই ছায়ার মালিক তার প্যেচানো সুরু শরীর বেয়ে জানালার একটা সাইড দিয়ে ঢুকে পড়লো সামিয়ার ঘরে। সামিয়ার বিছানার ঠিক সামনে এসে সেই বস্তুটি ধীরে ধীরে মানুষের রূপ নিতে শুরু করলো।
সামিয়ার শরীরে বস্ত্র ঠিক অবস্থায় নেই। লজ্জা জনক স্থান গুলো বোঝা যাচ্ছে।
সেই মানব রুপি শয়তান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামিয়ার দিকে। মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই গিলে খাবে তাকে।
কয়েক মুহূর্ত এইভাবে তাকিয়ে থাকার পর কি যেনো মনে করে সেই আগের রূপে ফিরে এসে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেইদিক দিয়েই হিসহিস শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলো। তার সেই শব্দে একটা স্পষ্ট সুর ছিল। সেটা যেনো বলছিল, "সামিয়া! শীঘ্রই আমি আবার আসবো।"
দুই ঘন্টা বাদে সামিয়ার মা সামিয়াকে ডাকতে আসে। হাতে খাবারের প্লেট।
তার মা জানে তার মেয়ে গোসল করে ঘুমিয়ে গেছে। আর সামিয়ার মায়েরও মন খারাপ, কারণ তিনি অকারণে তার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে। কারণ সামিয়ার তো এইসব ঘটনার সাথে কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু একটা অভিশাপ যে তার মেয়ের পিছে লেগেই আছে। অনেক চেষ্টার পরেও সেটা দূর করা যায়নি।
সামিয়া তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দরজায় মার জোর কষাঘাতে ঘুম ভেঙে যায় তার। ঘুম থেকে উঠে দেখে তার শরীরের প্রায় অর্ধেকের বেশি বের হয়ে আছে। তাই সে দ্রুত আলমারি থেকে তার জামা কাপড় বের করে গায়ে দিয়ে দরজা খোলে।
খাবারের প্লেট হাতে তার মা ভিতরে প্রবেশ করে জোর করে খাইয়ে দেয় তার মেয়েকে।
সামিয়া কোন কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নেয়। তার দিনটা সেইভাবেই চলে যায়। আর এইদিকে তার বাবা সব জায়গায় পয়সা খাইয়ে দিয়েছে, যাতে তার মেয়ের উপর কোন দোষ না চাপে।
রাতের বেলা গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে আছে সামিয়া। হঠাৎ করে তার ঘুম ভেঙে যায়। বিজ্ঞান বলে ঘুমন্ত অবস্থায় যখন কেউ সেই ব্যাক্তিকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তবেই হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু সামিয়ার ঘরে সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ নেই। তখন সামিয়া জানালার দিকে তাকায়। একটা কালো মানব মূর্তি নজরে আসে তার। সামিয়ার জায়গায় অন্য মেয়ে হলে চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলতো। কিন্তু সামিয়া এইসবে অভ্যস্ত। সামিয়া শয্যা ছেড়ে উঠে বসতেই জানালার ধারে গত দিন রাতের মত ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ শোনা গেলো। আর ছায়া মানব গায়েব হয়ে গেলো। সামিয়া ভাবতে লাগলো, কেনো তার সাথেই সব সময় এইরকম হয়ে থাকে। সে কি কোনোদিন স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচতে পারবে না?
আর সে আজও মানুষ?
এইসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তার। সে আবার শুয়ে পড়লো তার বিছানায়। কিন্তু এইবার আর তার চোখে ঘুম আসলো না। বাকি রাতটা তার জেগে থেকেই কেটে গেলো।
পরদিন সকালে সামিয়া কলেজ যাবে। কিন্তু তার বাবা মা এই অবস্থায় তাঁকে কিছুতেই ছাড়বে না। কিন্তু সামিয়ার জেদের সামনে তারা পরাজিত। সামিয়াকে যেনো কেউ কোন কথা না শোনায় সেই জন্য তার বাবা কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে ফোন করে আলাপ করে নিয়েছে।
অনেক দিন পর কলেজে এসেছে সামিয়া। পুরো কলেজ সামিয়ার ব্যাপারে জানে। তারা এও জানে যদি তারা সামিয়াকে এই বিষয়ে কোন কথা বলে তাহলে তার অবস্থা হবে ভয়াবহ।
কিন্তু কলেজে নতুন কিছু বড় লোক বাপের বিগরে যাওয়া ছেলে ভর্তি হয়েছে। সামিয়াকে দেখেই তাদের মনে লোভ জাগে। পিছু করতে শুরু করে সামিয়ার। কলেজের অনেকেই তাদের বুঝায় এর পরিণাম ভালো হবে না, কিন্তু কে শোনে কার কথা।
তাদের মধ্যে একজন সবার সামনেই সরাসরি সামিয়াকে প্রোপজ করে বসে। কিন্তু সামিয়া উল্টো তাকে কষিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। এতে লজ্জিত হয় তারা। আর সেখান থেকে চলে যায়।
কলেজ শেষে সামিয়া যখন তার গাড়ির কাছে যাবে তখনই এক দল যুবক ক্লোরফোম দিয়ে অজ্ঞান করে দেয় তাকে। আর গাড়িতে করে নিয়ে যায় জঙ্গলের উদ্দেশে। উদ্দেশ্য সামিয়াকে রেপ করা।কিন্তু তারা জানে না তারা কোন বিপদের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
Picked up.
পর্ব: 01
চলবে........
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন